ভ্রমণ গন্তব্য গুলোর সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক চিরকেলের। তাই আজ সেই একই ভাবে বেছে নিলাম আমার ভ্রমণ গন্তব্য , চলে এলাম রাজবলহাট এ রাজবল্লভী মাতার মন্দিরে |
মন্দিরে কি আছে?
মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি নাট মন্দির। তারপর রাজবল্লভী মাতার মন্দির। মায়ের মন্দির ছাড়াও আছে আট চালা একটি দুয়ার বিশিষ্ট তিনটি শিবের মন্দির। এবং আলাদা ভাবে ষড়ভুজাকৃতি আরো একটি মন্দির। এই মন্দিরগুলোতে অবস্থান করছেন ত্রম্বকেশ্বর , সোমেস্বর , এবং একই মন্দিরে আছেন রাজ্ রাজেস্বর ও নন্দীশ্বর। এছাড়া ষড়ভুজাকৃতি মন্দিরে অবস্থান করছেন বানেশ্বর মহাদেব। আর আছে মায়ের বাড়ির পুকুর ,যা শাখারি পুকুর নামেও খ্যাত।
মূল মন্দিরে রাজবল্লভী মায়ের বিগ্রহটি প্রায় ছয় ফুট উঁচু , দীর্ঘাঙ্গি ও বলিষ্ট প্রকৃতির। রাজবল্লভী মা শঙ্খ শ্বেতবর্ণা এবং খুব উজ্জ্বল । শ্বেতকালী নামে পরিচিত রাজবল্লভী মা গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মিত। এই দ্বিভূজা ত্রিনয়নী মূর্তির ডানহাতে ছুরি ও বামহাতে আছে রক্তপাত্র। মায়ের মাথায় আছে টায়রা জাতীয় মুকুট । মায়ের বাম পা টা রাখা বিরূপাক্ষ মহাদেব এর মাথায় আর ডান পা রাখা আছে শায়িত মহাকাল ভৈরবের বুকে।
প্রতিদিন দেবীর অন্নভোগ হয় , আর তার মূল আকর্ষণ ঘন্ট, আর তাতে দেয়া হয় কুচো চিংড়ি । আর দর্শনার্থী রাও এই ভোগ খেতে পারেন। তার জন্য সকালে এসে ২৫ টাকার বিনিময়ে কুপন সংগ্রহ করতে হয় |
জাঙীপাড়া ও রাজবলহাট সংলগ্ন এলাকায় দেবী দুর্গা রাজবল্লভী দেবী রূপে পূজিতা হন। প্রায় ৫০০ বছরের পুরাতন এই মন্দির বহুবার সংস্কার কার্যের ফলে প্রাচীন ঐতিহ্য অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে।
রাজবলহাটের ইতিহাস
বর্তমানের রাজবলহাট এর নামটার বুৎপত্তিও কিন্তু রাজবল্লভী মাতার নাম থেকে। প্রাচীন বাংলার রার অঞ্চলের দক্ষিণ অংশে উল্লেখযোগ্য হিন্দু রাজ্য ছিল , যার নাম ভুরীশ্রেষ্ট বা ভুরসুট। আর এই রাজবলহাট ছিল অতীতের ভুরশুট রাজ্যের রাজধানী।
ভুরসুট অঞ্চলের অধিবাসীরা "ভুরিশ্রেষ্ঠী" নামে পরিচিত ছিল। এরা ছিল মূলত বণিক। এদের নামানুসারেই রাজ্যের নামকরণ হয় "ভুরশুট"। পাল সাম্রাজ্যের উত্থানের সময় কোনো এক সুর রাজা এই রাজ্য শাসন করলেও পরবর্তীকালে ধীবর রাজবংশের উত্থান ঘটে।
চতুরানন্ এর নাতি (মেয়ের ছেলে) কৃষ্ণ রায় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে মানে ১৫৮৩-৮৪ খৃষ্টাব্দে ভুরশুটের ব্রাহ্মণ রাজবংশের পত্তন ঘটান। তাঁর প্রপৌত্র প্রতাপনারায়ণ রায় (১৬৫২-১৬৮৪) ছিলেন ভুরশুটের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। তার পুত্র শিবনারায়ন, তস্য পুত্র নরনারায়ণ রায় ভুরশুটে রাজত্ব করেন। এই পরিবারে "রায়বাঘিনী" নামে এই বীরাঙ্গনা মহিলার কথা জানা যায়। তবে তাঁর সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না। সম্ভবত তাঁর নাম ছিল ভবশঙ্করী। ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়নের সাথে তার বিবাহ হয়।
নরনারায়নের রাজত্বকালের শেষে বা তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বর্ধমান রাজ কীর্তিচন্দ্র ভুরশুট রাজ্য দখল করে নেন। ভুরশুট রাজ্যে তিনটি দুর্গ ছিল। এগুলি হল গড় ভবানীপুর, পান্ডুয়া (পেড়ো বা পেড়ো বসন্তপুর) ও রাজবলহাট। এই দুর্গগুলির এখন আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে হাওড়া জেলায় রাজবলহাটের কাছে দামোদর নদের তীরে ডিহি ভুরশুট বলে একটি জায়গা এখনও আছে। ৫০০ বিঘা জমিকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেছিলেন ভূরশুট রাজারা দেবী রাজবল্লভীর মন্দিরের সেবায়। এই দেবীর মন্দির বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে।
মন্দির প্রতিষ্টা
ভুরশুটের শেষ ধীবর রাজা শনিভাঙ্গর গড় ভবানীপুরের চতুরানন্ নিয়োগী নামক এক ব্যক্তির কাছে পরাজিত হন। শোনা যায় চতুরানন এর জামাই আর বর্ধমানের রাজা সদানন্দ রায় এই মন্দির প্রতিষ্টা করেন এবং এই স্থানে জনপদ ও বাণিজ্য কেন্দ্রও স্থাপন করেন।
তবে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ, রাজা রুদ্রনারায়ন রায়, সোরোস শতকে ভুরসুট সাম্রাজ্যের শাসনকালে এই মন্দির এবং মূর্তি পুনঃ প্রতিষ্টা করেন।
আর কি দেখার আছে?
>এখানে অমূল্য প্রত্নশালা নামে একটি সংগ্রহালয় আছে। প্রতিদিন দুপুর ২ টো থেকে রাত ৯ টা অব্দি খোলা থাকে। বুধবার বন্ধ। এবং প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ মঙ্গলবারও বন্ধ থাকে। এখানে এলে দেখতে পাবেন , কাঠের ও পাথরের মূর্তি , কয়েন , টেরাকোটার কাজ , পাণ্ডুলিপি , ডোকরার কাজ , পুরাতন পুঁথি , কাঠের ওপর খোদাই করা চিত্র আর ফ্লক আর্ট।
>রাজবলহাট বিখ্যাত তার তাঁত শিল্পের জন্য। এখানে এলে হ্যান্ডলুম এর শব্দ এখনো শোনা যায় , এমনকি সুতা শুকাতে দেওয়াও দেখতে পাওয়া যায়।
অবস্থান
হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া ব্লকে
কিভাবে আসবেন?
কাছাকাছি রেল স্টেশন বলতে ১৮ কিমি দূরে হরিপাল বা ১৬ কিমি দূরে তারকেশ্বর। তাই সকালের তারকেশ্বর/ গোঘাট / হরিপাল লোকাল ধরে একঘন্টার মধ্যে চলে আসুন হরিপাল স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেকার বা বাসে আধ ঘন্টায় চলে আসতে পারেন এই মন্দিরে।
#rajballavi_mandir #rajbalhat
সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্রটি দেখতে
0 Comments
Thank You for comments in Know Your Planet. I'll be in touch with you shortly.